সুমন কুমার মিত্র : লালগোলা একটি প্রাচীন জনপদ। পদ্মা,গঙ্গা ও ভৈরব – এই তিন নদী বিধৌত শ্যামল বনানী ঘেরা স্থানের রথযাত্রা বঙ্গদেশের কয়েকটি বিখ্যাত রথযাত্রা ও রথের মেলার মধ্যে প্রসিদ্ধ।আজ থেকে ১৯৭ বছর পূর্বে এর সূচনা হয়।
উত্তর প্রদেশের গাজিপুর জেলার পালীগ্রাম থেকে মহিমা রায় নামে এক জনৈক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তি পদ্মাী পূর্বে অবস্থিত সুন্দরপুর ( বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ থানার অধীন) গ্রামে এসে বাস করতে শুরু করেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি কোন সম্পত্তি রেখে যেতে পারেন নি তবে দুটি তেজস্বী পুত্র রেখে যান।
সুন্দরপুর গ্রাম পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দলেল রায় ও রাজনাথ রায় যখন পদ্মার অপর পারে মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা গ্রামে বাসা বাঁধলেন , লালগোলা তখন নিবিড় জঙ্গলে পূর্ণ । লোক বসতি সামান্য , ব্যবসা -বাণিজ্য বিশেষ নাই কিন্তু এই ভাগ্য বিপর্যয়ের মাঝেই লুকিয়ে ছিল দলেল রায়ের ভাগ্যোণ্মেষ ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে তখন অশান্তির কালো মেঘ। সেই কালো মেঘ থেকে বজ্রাঘাত হল মুর্শিদাবাদ নবাব বংশে অন্য দিকে একই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ল লালগোলা রাজ পরিবারের ওপর ।এই মেঘের অবিরাম বর্ষণ রাজ পরিবারের অঙ্কুরকে মহীরুহ করে তুলল ।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র বিপ্লবের সাথে দলেল রায়ের সৌভাগ্য শুরু হয়।১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে নবাব সরফরাজ খাঁকে সিংহাসন চ্যুত করে আলিবর্দ্দী খাঁকে বাংলার মসনদে বসানোর যে ঘৃণিত ষড়যন্ত্র চলছিল তার ক্লাইমেক্স লেখা হয় গিরিয়ার যুদ্ধে ।
আলিবর্দ্দী আজিমাবাদ থেকে সূতি এসে উপস্থিত হলে নবাব সরফরাজ খাঁ লালগোলার দেওয়ান সরাইয়ে শিবির স্থাপন করেন । মুর্শিদাবাদ থেকে নবাব নির্মিত রাজপথ দেওয়ান সরাইয়ের বুক চিরে চলে গিয়েছে উত্তর দক্ষিণে। সেসময় এটিই নবাবদের যাতায়াতের মুখ্য পথের একটি ছিল।
এ বিষয়ে একটি গ্রাম্য কবিতা রয়েছে-
” নবাবের তাম্বু পড়িল ব্রাহ্মণের স্থলে
আলিবর্দির তাম্বু তখন পড়িল রাজমহলে।
নবাবের তাম্বু যখন পড়িল দেওয়ান সরাই,
আলিবর্দির তখন আইল ফারাক্কায়।”
সে সময় দলেল রায় বহু উপঢৌকন নিয়ে নবাব শিবিরে উপস্থিত হন। নবাব তাঁর অনেক সদগুণ লক্ষ্য করে তাঁকে জিলাদারী (জলপথে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব) কাজে নিযুক্ত করেন। জিলাদারী কাজ করে বহু অর্থ সঞ্চয় করে কিছু সম্পত্তি ক্রয় করেন । লালগোলাতে দুই ভাইয়ের শ্রী বৃদ্ধি হয় বলে এই গ্রামের নাম দেওয়া হয় শ্রীমন্তপুর ।এভাবে প্রতিষ্ঠিত হল লালগোলা রাজ এষ্টেটের ।
লালগোলা রাজ পরিবারের উন্নতি সর্বাপেক্ষা যাঁর হাত ধরে হয়েছিল, তিনি হলেন রাজা রাও রামশঙ্কর রায়। লালগোলা রথযাত্রার প্রচলনও তাঁরই হাত ধরে।
সময়টা ১২২৯ বঙ্গাব্দ ইংরেজী ১৮২৩ সাল, রাজা রাও রামশঙ্কর রায় একটি বিশাল কাঠের কারুকার্যময় রথ তৈরী করান। সেই রথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রতিদিকে ত্রিশ হাত, উচ্চতা ছিল একশ হাত। এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ১২৩০ বঙ্গাব্দে ইংরেজী ১৮২৪ সালে এই রথযাত্রার সূচনা হয়। কুলদেবতা শ্রীশ্রী দধীবামন দেব যাঁর অপর নাম সুদর্শন দেব তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য এই যাত্রার প্রচলন। বর্তমান রাজবাড়ির ( যেটি এখন মুক্ত সংশোধনাগার ) তার ভেতরে নাট মন্দিরের পেছনে দোতলায় উত্তর দিকে শ্রীশ্রী দধীবামন দেবের মন্দির। পূর্বে সেই মন্দির থেকে শ্রীশ্রী দধীবামন দেবকে পূজা করে লাল শালুতে করে ঢেকে নিয়ে এসে রথে তোলা হত। এখন তাঁর নিবাস ১৩৩১ বঙ্গাব্দে লালগোলা রাজ পরিবারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, জুম্মন সেখ দ্বারা নির্মিত নারায়ণ মন্দিরে। সেই মন্দির থেকে দধীবামনদেবকে যাঁর অপর নাম নারায়ণও বটে একই নিয়মে এনে রথে তোলা হয়। ভক্তরা দড়িতে হাত দিলে রথ বিকেলে রাজপথে বের হয় এবং এক কিলোমিটার দূরে মাসির বাড়িতে যেটি রাজপরিবার দ্বারা নির্মিত নাট মন্দির সেখানে পৌঁছায়।
কাঠের রথটি বহুদিন পর ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকলে রাজা রাও রামশঙ্করের পুত্র রাও মহেশ নারায়ণ রায় একটি সুদৃশ্য রথ নির্মাণ করেন লোহা ও পিতল দিয়ে। বর্তমানেও সেই রথ লালগোলার গর্ব হিসেবে চিহ্নিত, যদিও তাঁর জৌলুস অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে তাও আজও এই পিতলের রথ লালগোলার ঐতিহ্য বহন করছে।
এবছর অতিমারীর জন্য প্রশাসনিক অনুমতি না মেলায় অতি প্রাচীন এই রথযাত্রা স্থগিত রয়েছে,তবে দধীবামন দেবের শিলা সিংহাসনে বসে পুরোহিত ও ভক্তের হাতে হাতে পৌঁছবে তাঁর মাসির বাড়ি। মেলা এবছর বন্ধ, ফাঁকা থেকে যাবে লালগোলা সব ধর্মের মানুষের একটি মিলন ক্ষেত্র লালগোলা রাজবাড়ী প্রাঙ্গন। আশা করা যায় আগামীতে এ দুর্দিন কেটে গেলে আবার রথযাত্রা উৎসব তাঁর পুরোনো রূপ ফিরে পাবে।
Thanks