নবরূপে : কল্পনা মিত্র 

0
162

নবরূপে : কল্পনা মিত্র 

মৌমিতা কে তুলসীতলায় প্রদীপ হাতে প্রণাম করতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হলো সায়ন। এ দৃশ‍্য যে কোনদিন দেখবে কল্পনাতেও আসেনি তার। আবার দেখবে না বলে মনে কোন দুঃখও ছিল না। জিনস্ আর টপ্ কিংবা প‍্যান্ট সার্ট পরা মৌমিতাকে দেখতে অভ‍্যস্ত সে। দেশে বেশীদিন থাকলে কুর্তি পাজামা আর সালোয়ার স‍্যুট পরে। সায়ন নিজেকে প্রশ্ন করে তার অবচেতন মন কি এই রকম গৃহবধূকেই মনে মনে পছন্দ করতো? তাহলে সে কি করে অফিস কলিক মৌমিতাকে পছন্দ করেছিল! নিয়মিত ঘর সংসার সামলানো মাকে দেখে দেখে কি সে নিজের জীবনের স্বাদ বদল করতে চেয়েছিল মাত্র! শিক্ষিত হয়েও যদি তার বৌটা ঘরকুনো হতো তাহলে কি সে খুশী হতে পারতো নাকি স্বল্প শিক্ষিতা মেয়েকে যখন তখন ‘আনকালচারড্ আর অশিক্ষিত ‘বলে পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখে খুশী হতো?
মৌমিতা আর সায়ন কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে চাকরি করে মাঝে মাঝেই বিদেশ যায়। মাঝে মাঝে ওদের মনে হয় ওদের জীবন শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্রের জন‍্য, সংসার পাতার জন‍্য নয়। সেই ছেলেবেলা থেকে বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে ওরা ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে উঠেছে যেন শুধুমাত্র জীবনে উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র পাওয়ার জন‍্য। আজও সেই কর্মক্ষেত্রকে প্রধান‍্য দিয়ে সমস্ত নিজস্বতাকে কখন নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলেছে।
বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি নিয়ে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পরছিল এমন এক মুহূর্তে সৌভাগ্যবতীর মতন মৌমিতা ভারতবর্ষে নিজের বাসস্থানে ফিরে এসেছিল, কিন্তু লকডাউনে উড়ান চলাচল ব্ন্ধ হওয়ার কারণে সায়নের সুইজারল্যান্ড থেকে সেই সময় ফেরা হয়নি। মা বাবা বাড়িতে একলা! তাই এই লকডাউনের সময় যাই হোক পাশে উপযুক্ত বয়সের কাউকে তাঁরা পেলেন এই ভেবে মৌমিতা ফেরাতে সে একটু নিশ্চন্ত হয়েছিল। মৌমিতার মা- বাবা দক্ষিণ কলকাতায় নিজস্ব বাড়িতে থাকেন পুত্র এবং পুত্রবধূর সাথে। মৌমিতা একারণেই নিজের মা-বাবার ব‍্যাপারে খানিকটা নিশ্চিন্ত বলা চলে।
সায়ন মুগ্ধ চোখে মৌমিতাকে দেখছিল। বেশ কিছু দূর থেকেও সে মৌমিতার শরীর থেকে মিষ্টি একটি গন্ধ অনুভব করছিল। এ গন্ধ কোন বডি স্প্রে বা পারফিউমের গন্ধ নয়। এ গন্ধ সেই এক অতি পরিচিত ফুলের যার নামটা এই মুহূর্তে সে মনে করতে পারছে না।
যে তুলসীতলার কথা সায়ন বলছে সেটা উঠোনের মাঝখানে বাঁধানো বেদীর ওপর তুলসীগাছ স্থাপন করা তুলসীতলা নয়। ব‍্যালকনিতে স্টীলের হুকে ঝোলানো টবে লাগানো তুলসীগাছ মাত্র। তাও তো একেও তুলসীতলা বলা যেতেই পারে। মৌমিতার পরণে সবুজ পাড় দুধে আলতা রঙের সিল্কের সাড়ী। হাত খোঁপাটা ঘাড়ের ওপর ঝুলছে। সাড়ীল আঁচল গায়ে এমন ভাবে জড়ানো যেন মনে হচ্ছে আলতো করে মাথার ঘোমটাটা খোঁপার ওপর ঝরে পরেছে। বৌভাতের দিন দুপুরে মৌমিতা ঠিক এমনি করেই আধ ঘোমটা মাথায় তার হাত থেকে ভাত কাপড়ের থালা ধরেছিল।
এবারে পরিস্থতির চাপে বহুদিন ওরা আলাদা কাটিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিদেশে থাকাকালীন সায়ন অনুভব করেছে দেশের প্রতি তার টান কতোখানি। মহামারির দৌরাত্মে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এই আত্মীয় পরিজনহীন দেশে সে যদি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়….এ জীবনে যদি আর কারও সাথে তার আর দেখা না হয়….! উল্টোদিকে ভেবেছে তার মা-বাবার কথা। তাঁরা যদি চিরকালের জন‍্য চলে যান কি হবে….! রোজ ভিডিও কলে একবার অন্তত বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে ভুল হতো না। মা -বাবা বলতেন,-“আমাদের জন‍্য চিন্তা করিস না সায়ন, বৌমা আমাদের নিয়মিত মাল্টি ভিটামিন আর ভিটামিন সি খাওয়াচ্ছে এ ছাড়া আদা জল, নিত‍্য প্রোটিন যুক্ত খাবার খাওয়াচ্ছে। তুই তোর দিকে খেয়াল রাখ বাবা।” সায়ন মনে মনে বলে ‘এই জন‍্যই তো শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করেছি, তোমরা কি তা বোঝোনা?’ মৌমিতার জন‍্য তার যতটা ভালোবাসা আর ভালোলাগা ছিল সায়ন নিজেই বুঝে ওঠেনা কি করে সেই আবেগজনিত অনুভূতিগুলো বিয়ের কয়েক মাসের মধ‍্যেই আপনি কমে গিয়েছিল। এছাড়া ওদের দুজনের মধ‍্যে কেউ না কেউ অফিসের কাজে বাইরে থাকে তাই ওরা এখনো পর্যন্ত সুখী গৃহকোণের আস্বাদ যে কি তা অনুভব করার সুযোগটাও পায়নি। মৌমিতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকার অভ‍্যাসটা সায়ন হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিল। হয়তো বা এর মধ্যে খানিকটা ইগো কাজ করছিল। মৌমিতার পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে ওঠাবসা সায়নের মনের কোনো কোণে ঈর্ষার সৃষ্টি করতো। এইভাবেই যদি জীবনটা কেটে যায় যাক, না হলে ডিভোর্স ছাড়া গতি নেই। তবে লকডাউনের আগেই মৌমিতার বাড়ি ফিরে আসার সংবাদ তাকে স্বস্তি দিয়েছিল এটা মানতেই হবে।

মৌমিতা ঠাকুর ঘরের দিক যাচ্ছে। দীর্ঘদিন বাদে লগ ডাউন ওঠার পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে দেখে পরম শান্তিতে মা বাবাকে নিয়ে আজ অসুস্থ দাদাকে দেখতে গেছেন। প্রদীপের শিখা আর ধূপের গন্ধে ঠাকুর ঘরের স্নিগ্ধ পরিবেশ থেকে বেড়িয়ে মৌমিতা ঘরে গেল হয়তো পোশাক পরিবর্তন করতে। সায়ন পেছন পেছন ঘরে ঢুকে মৌমিতার হাতটা চেপে ধরলো-” নাঃ প্লিজ আর কিছুক্ষণ এই পোশাকেই তুমি থাকো মৌমিতা,আমি তোমার এই অপরূপ রূপটা দেখি।” ঘরের হালকা সবুজ আলোয় মৌমিতা মিষ্টি হেসে ফিরে তাকালো।
-“এ রূপ দেখার কি আছে সায়ন, বেশ ক’দিন বাড়িতে থেকেছি তাই এই সাজে আমি প্রায়ই সাজি। লগডাউনে রাঁধুনীহীন রান্নাঘরে আমি প্রায়ই রান্নাও করি। এখন তুমিও এসেছো, এখন দীর্ঘদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে হলে আমাকে এই ভাবে বার বার দেখলে তোমার দেখার উৎসাহ কমে যাবে। সবটাই আসলে নিত‍্য ডাল ভাত তরকারির মতন একঘেয়ে হয়ে যাবে সায়ন। এখন প্লিজ বাইরে যাও আমি চেঞ্জ করবো। মা-বাবা ফিরে এলে একটু আমার বাবা-মাকে দেখতে যাবো।” মৌমিতাকে হালকা সবুজ আলোয় রহস‍্যময়ী মনে হচ্ছিল। সে
মিষ্টি হেসে সায়নকে আলতো ভাবে ঘরের বাইরে ঠেলে দিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল।
গতকাল সায়ন ফিরেছে। মা বাবার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছে। মা বার বার বলছিলেন, -“আজ তুই এসে যাতে আমার হাতের রান্না খেতে পাস তাই বৌমা আমায় রান্না করতে দিয়েছে না হলে মঙ্গলা আসছে না বলে বৌমাই সব রান্না করে।” রাত্রে ক্লান্ত শরীরে ঘরের বিছানায় মৌমিতার আগেই ঘুমিয়ে পরেছিল সে। মা বাবা ফিরতে মৌমিতা বাপের বাড়ি যাবে বলে পা বাড়াতে সায়ন বললো,
-“সাবধানে যেও।”
-মৌমিতা থমকে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে বললো,
–“হঠাৎ আমি সাবধানে যাবো না তোমার এমন মনে হলো কেনো! ”
–“না এমনি বললাম,আজই ফিরবে তো?” বাবা সায়নকে বললেন ‘
-” মানে! কিরে সায়ন তুই বৌমার সঙ্গে যাচ্ছিস না?”
-“আমি আবার কেন?” সায়ন হতভম্ব।
-“ও থাক বাবা, খুব টায়ার্ড, বিশ্রাম নিক বাড়িতে।” মৌমিতা বললো।
-“কেন সায়ন, ইয়ংম‍্যান তুমি, তুমি এখনও কেনো টায়ার্ড?” বাবা বিরক্ত হলেন। মা বললেন,
-“এতোদিন বৌমা তোমার বাবা-মায়ের খেয়াল রাখলো,আজ তোমার উচিৎ তাঁদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের খবর নেওয়া।”

ড্রাইভারের সিটে মৌমিতা। গাড়ি চালাচ্ছে। সায়ন বোল্লো,-“সরি মৌমিতা।
-মৌমিতা সামনে রাস্তার দিকে চেয়ে উত্তর দিল,-“ইটস ওকে।” রাস্তাটা মোটেও ওয়ান ওয়ে নয়, উল্টো দিক দিয়ে এক বাইক আরোহী বাইক সমেত তাদের গাড়ির মুখোমুখি হতেই সায়ন -“সাবধান ” বলে স্টিয়ারিংএর ওপর রাখা মৌমিতার হাতটা ধরতে যাচ্ছিল, মৌমিতা দক্ষ ড্রাইভারের মতন গাড়িকে বিপদমুক্ত করলো। সায়ন বললো, -“সরি”
-মৌমিতা ওর দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
–“সরি ফর হোয়াট?”
–” আসলে তোমরা হলে মনুষ‍্য সেরা মা দশভূজা। আমরা বার বার তোমাদের অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু তোমরা সমস্ত পরিস্থিতিতে কেমন সহজে উতরে যাও! তাই বলছি সরি।”
মৌমিতা তার বাপের বাড়ির দোর গোড়ায় আস্তে করে গাড়ি থামিয়ে বললো -“হয়েছে? এবার নামো।আমরা এসে গেছি।” নাটকীয় ভঙ্গিতে হাতজোর করে সায়ন বললো,-” ক্ষমা করো হে ক্ষেমংকরী।”মৌমিতা না হেসে পারলো না তবু
মেকি কপট স্বরে বললো, -“ক্ষমা না করলে যদি না নামো বসে থাকো। আমি দরজা লক করে গাড়ির চাবি নিয়ে চললাম। আজ মনে হয় ফিরবো না।”
সায়ন তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে ওর পাশে দাঁড়ালো।
-“তাহলে কিন্তু আমিও থাকবো।।”মৌমিতা মৃদু হেসে বললো,-“এ কেমন বায়না! বেশ যদি আজই ফেরার ইচ্ছে থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার আগে আমার বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে উপস্থিত হও।”

রাতের বেলা শোওয়ার ঘরের পবিত্র মৃদু সবুজ আলোয় দুটি শরীর, দুটি মন মিলেমিশে একাকার হলো।

Google search engine

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here