কৃষ্ণা – (ছোট গল্প)

0
142

কল্পনা মিত্র : কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি হেলমেটটা মাথায় চাপিয়ে স্কুটিতে স্টার্ট দিলো। লিস্ট মিলিয়ে কেনাকাটা শেষ , এখন ঠিকানা খুঁজে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে হবে।মানুষগুলো পথ চেয়ে বসে আছে। করোনার প্রথম স্টেজে বাবা-মা দুজনেই চলে গেছেন। সেকেন্ড স্টেজে কতজন যাবে জানা নেই । এবারেরটায় সে নিজেও যেতেই পারে! এ নিয়ে তার মাথা ব‍্যথা নেই। একটা ছোটখাটো প্রাইভেট অফিসে কাজ করে। এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। বেলা এগারোটা নাগাদ একটু আধটু কাজ শুরু হয়। আগের লকডাউনে মাইনেটাও আটকে গিয়েছিল , এবারে কিছু হাতে পাচ্ছে। এবারে মা,বাবাও আর নেই। অফিসের কাজে বসার আগে লকডাউনে গৃহবন্দী অসহায় মানুষদের নিত‍্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়েছে সে। কাছাকাছি ঠিকানা হলে একদিনে তিন-চারটে বাড়িতে পৌছে দেয়। আজকের লিস্টে দুটো বাড়ি। প্রথমটা সেড়ে দ্বিতীয় ঠিকানার বেল টিপতে দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়া দম্পতি। কৃষ্ণা বিচলিত। বছর তিনেক আগে এঁরাই রঙ কালো এই অজুহাতে তাকে ভবিষ্যত পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ না করে বাতিলের ঝুলিতে ফেলে দিয়েছিলেন। মাস্ক আর হেমলেট পরা কালো মেয়েটাকে আজ চিনতে পারছেন না হয়তো। কৃষ্ণা জানতে চাইলো “শুভ্রা?”

বৃদ্ধা ডাকলেন “বৌমা “। ছাপা সাড়ী পরা মুখে মাস্ক চাপা শুভ্র বর্ণের মেয়েটি এলো। শাশুড়ি -শ্বশুরের হাতে মাস্ক দিয়ে তাঁদের মাস্ক পরে নিতে বলে সে মাটিতে নাামানো জিনিস পত্রে স‍্যানিটাইজার ছড়ালো। বললো “তোমরা হাত দিও না আমি তুলবো।” মাটিতে রাখা বিলটা তুলে শ্বশুরকে বোললো -“সাতশো পঁয়ত্রিশ টাকা , মেঝেতেই রেখো আমি স‍্যানিটাইজ করলে উনি তুলে নেবেন। ” মেয়েটি একে একে জিনিসপত্র তুলতে ব‍্যস্ত। শ্বশুর মশাই টাকা আনতে গেলেন। প্রৌঢ়া বললেন – ” তুমি সমাজ সেবা করো? আমার ছেলেটা অকালে চলে গেছে। বৌমার বাবা-মা করোনাতে চলে গেলো। এটা বৌমার বাপের বাড়ি….ওর আর আমাদের কেউ নেই। দুটো বাড়ির ভাড়া গোণা সম্ভব হচ্ছিলো না তাই এখানেই থেকে গেছি। ”
একরাশ মন খারাপ নিয়ে কৃষ্ণা ফিরলো। শুভ্রবর্ণার জন‍্য মনটা খানিকটা উদাস হলো। স্নিগ্ধ -সুন্দর মেয়েটার জীবনটা কি এই ‘বৌমা ‘ হয়েই অল্প বয়সে থমকে যাবে! ভাবলো ‘ বিয়েটা আমার সাথে হলে এরকম দশা হয়তো আমারও হতে পারতো। ‘ সেই ছিল ওর ‘কণে দেখা ‘পর্বের শেষ ইন্টারভিউ। বাবা মা আর দ্বিতীয়বার তাকে কিছু বলতে পারেননি। নিত‍্য তাঁদের আদরের মেয়েটাকে শ‍্যামলা রঙের কারণে অপদস্থ হতে দেখতে ভালো লাগতো না। কৃষ্ণাও নিজের চেষ্টায় একটা চাকরি জোগাড় করে তাঁদের আরো নিশ্চিন্ত করেছিল।

দ্বিতীয়বার এই পরিবারে মাল পত্র দিতে গেলে আরও কিছু তথ‍্য তার সামনে তুলে ধরলেন বৃদ্ধা। তোমাদের মতন সমাজসেবীরা আছো তাই আমাদের মতন গ‍ৃহবন্দী মানুষদের চলছে। কি করো তুমি?” কৃষ্ণার উত্তর -“ছোট খাটো চাকরি।”
-বিয়ে করোনি?
-নাঃ।
-কে কে আছেন?
-বাবা-মা গতবারের করোনায় চলে গেছেন।
-ওঃ! জানোতো, লকডাউনের জন‍্য আমার কর্তা বা বৌমা কিছুই করতে পারছ না। বৌমা মাধ‍্যমিক পযর্ন্ত পড়েছে। এখন কর্তার অল্প পেনশন্ই ভরসা। পুঁজিও শেষ। কি হবে জানিনা।
প্রৌঢ় আজ একটা প‍্যাকেটে টাকা ভরে এনে মেঝেতে রাখতে রাখতে বললেন, ” আর বোধহয় কেনাকাটা,খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করতে হবে। এবাড়ির ভাড়াও আর কতদিন গুণতে পারবো জানিনা।”
– কৃষ্ণা ভাবছে ‘ এরকম দশা হয়তো আমারও হতে পারতো….কিন্ত এঁরা এখন আমার বিশেষ পরিচিত…বিপন্ন এই মানুষের যদি….একটু পাশে থাকি…. ‘ সে হঠাৎ বলে ফেললো- “আপনারা আমার বাড়িতে থাকতে পারেন। বাবার তৈরি বাড়ি। ওনারা আর নেই, ফিরবেন না কোনদিন…একাই থাকি। আসুন না ওবাড়ি। ভালো লাগবে।”

Google search engine

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here