অনুতাপ

0
143

কল্পনা মিত্র :  খুব সাবধানে কাদায় ভরা মাঠটা পার হলো ইন্দ্রানী।এখুনি হয়তো আবার বৃষ্টি নামবে। মা বারবার বলেছিল -“ছাতাটা নে ইন্দু বৃষ্টির জন‍্য আটকে পরলে চলবে না, বাবা ফিরলে কিন্তু রক্ষে থাকবে না।” নাঃ তাও নেয়নি ছাতা, সাড়ি সামলাবে নাকি ছাতা!মোবাইলটা এখনকার দিনে সঙ্গে না রেখে পারা যায় না ওটা যেন এখন শরীরের একটা অংগের মতন হয়ে গেছে। পেটে খাবার ঢুকুক কি না ঢুকুক মোবাইলে পেট ভর্তি চার্জ আছে কিনা সেটা দেখা অবশ‍্য করণীয় কাজের আওতায় পরে গেছে। আজ বিপ্লবের সাথে সরাসরি কথা বলতেই হবে। পাড়ার লোক হাসিয়ে সব সম্পর্ক যখন শেষ হয়ে গেছে তখন আবার কেন নকল নামে ফেসবুকে বন্ধুত্ব পাতাচ্ছে বিপ্লব। মাত্র দু বছরের বিবাহিত জীবনেই ও ধৈর্য্য হারা হলো তারপর বিবাহ বিচ্ছেদের নাটক করে আবার প্রেমে পাগল ! ভাবা যায় ! ম‍্যেসেঞ্জারে যে ভাষায় কথা বলে অনুতাপ নাম নিয়ে সে ভাষা ইন্দ্রানীর খুব চেনা।

ইন্দ্রানীর বাড়ির পেছন দিকের মাঠ পেরোলেই ‘নেতাজী পল্লী’। ওই পল্লীর দুর্গা ভাসানের সময় ধুনুচি নাচ নেচেছিল ইন্দ্রানী মৌসুমীর পাল্লায় পরে। প‍্যাণ্ডেলে প‍্যাণ্ডেলে ঠাকুর দেখে ফেরার সময় ওদের পাড়া দিয়ে ঢুকে মাঠ পার হয়ে বাড়ি ফিরবে বলে আসছিল , মৌসুমী টানতে টানতে নিয়ে গেল বিসর্জনের ঘাটে। ওদের দেখেই ছেলেরা বলে উঠলো, -“আয় মৌ ধনুচি নাচটা সেরে ফেল না হলে বিসর্জন আটকে থাকবে।” মৌসুমী জোর করে ইন্দ্রানীর হাতে একটা জ্বলন্ত ধুনুচি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,-“তুইও নাচ আমার সাথে।” নেচেছিল তবে কিছুক্ষণ পরে বিপ্লবও ওদের সাথে জ্বলন্ত ধুনুচি নিয়ে নেমে পরেছিল। ওই থেকেই ওদের আলাপ। বিসর্জনের শেষে মৌসুমী আর বিপ্লব এসেছিল মাঠ পার করে বাড়ি পযর্ন্ত এগিয়ে দিতে। তিন বছর প্রেম করার পর বিয়ে। প্রতি বছর ওদের পাড়ার ঠাকুর বিসর্জনের দিন ধুনুচি নাচে যোগ দিতে ভুল হতো না ইন্দ্রানীর। বিয়েতে বাবা-মাকে রাজি করাতে বেগ পেতে হয়নি। ছেলে ভালো। ভালো চাকরি করে। একমাত্র সন্তান কাছাকাছি থাকবে। নিজেদের বাড়ি। দুজনে দুজনকে চেনে..আর কি চাই!

শ্বশুরবাড়ির মানুষ বলতে বিপ্লব আর তার মা। মা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এখন রিটায়ার্ড। বেশ সুখের সংসার। প্রথম বছর বিসর্জনের দিন ধুনুচি নাচ করতে চায়নি ইন্দ্রানী। তাছাড়া মৌসুমীও বিয়ে করে বরের সাথে পুজোর ছুটিতে বাইরে ছুটি কাটাতে গেছে। তাই বলেছিল,-“বিয়ে হয়ে গেছে,আর না হয় নাইবা নাচলাম।” বিপ্লব শোনেনি জোর করে নিয়ে গিয়েছিল বিসর্জনের ঘাটে। দ্বিতীয় বছর ইন্দ্রানী বিপ্লবের ডাকের অপেক্ষায় না থেকে নিজের থেকেই গিয়েছিল বিসর্জনের ঘাটে। বিপ্লব ছিল না ওখানে। এলো মাকে সঙ্গে নিয়ে। একা একা এখানে এসেছে বলে সবার সামনে বকাঝকা করলো। ধনুচি নাচ নিজেও নাচলো না, ইন্দ্রানীকেও নাচতে দিলনা। বিপ্লবকে এই রকম কোনদিন দেখতে হবে ভাবতে পারেনি সে। ফিরে এসেছিল বাড়ি। শাশুড়িমাকে নিয়ে বিপ্লবও ফিরেছিল। কিন্ত ব‍্যপারটা সেখানেই শেষ হয়নি। আকস্মিক ঘটনাতে ইন্দ্রানী বিব্রত বোধ করেছে জানালে বিপ্লব যেন ফেটে পরেছিল, অনেক তর্কাতর্কি চলে, সবচাইতে আশ্চর্যের ব‍্যাপার সেদিন বিপ্লব ইন্দ্রানীর চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশও করেছিল। শাশুড়ীমা কোন কথাও বলেন নি বাধাও দেননি।…সব শেষে অপমানিতা ইন্দ্রানী চলে আসে বাপের বাড়ি ….কয়েকদিনের মাথায় বিপ্লবের কাছ থেকে আসে ডিভোর্সের নোটিশ। তিন মাসের মাথায় একটা সইয়ের বিনিময়ে তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।

বিপ্লবের বাড়ির কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে বিপ্লব সামনে এসে দাঁড়ায়। -“জানতাম তুমি আসবে। এসেছো যখন ঘরে এসো।” বিপ্লবের কথার উত্তর না দিয়ে ইন্দ্রানী বাড়ির ভেতরে ঢোকে। বিপ্লব ততক্ষণে দরজা ভেজিয়ে সোফার দিকে এগিয়ে গেছে। -“বসো।” ইন্দ্রানী বললো,-“বসবো বলে আসিনি, কিছু জানতে এসেছি…. তুমি যা চেয়েছো আমি তো তাই দিয়েছি তাহলে এখন কেন অনুতাপ নাম নিয়ে আমাকে বিরক্ত করছো?”
-“অনুতাপকে তুমি চিনতে পেরেছো! আমি জানতাম তুমি চিনতে পারবে।” বিপ্লবের মুখে জয়ের হাসি।
–“বাঃ! না চেনার কি আছে! দীর্ঘ তিন বছর ওই ভাষাতেই তো তুমি আমার সাথে কথা বলতে।”
-” তুমি আমার ভাষা চেনো আমাকে জানো। তাহলে শুধুমাত্র ওই একদিনের ভাষা শুনে বোঝোনি ওটা আমার ভাষা নয়…বোঝনি ওই মানুষটা আসল আমি নয়! আমায় ছেড়ে ,বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে!”
–“মানে…!” বিস্ময়ের চোখে ইন্দ্রানী বিপ্লবকে দেখলো। বিপ্লব বললো,-“বসো।” ইন্দ্রানী বসার জন‍্য বিপ্লবের উল্টোদিকের সোফার কাছে যাওয়ার সময় একটু ভেতর দিকের ঘরে চোখ ফেরালো,তাই দেখে বিপ্লব বললো,-” মা আর নেই। মা চলে গেছে।” বিস্ফারিত চোখে ইন্দ্রানী বিপ্লবের দিকে তাকালো,-“মানে!”
বিপ্লব বললো মা ফিরে গেছেন তাঁর স্বামীর সংসারে। …একটা সত‍্যি কথা তোমাকে বলা হয়নি, এ পাড়ার কেউ জানে না আমার মা বিধবা নন্ তিনি ডিভোর্সী। আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম বাবা মাকে ডিভোর্স করে দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন। মা প্রচণ্ড সকড্ হয়েছিলেন। কথা বলতেন না, খেতেন না, চুপচাপ থাকতেন। স্কুলে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। মা দাদুর একমাএ সন্তান। আমি তখন একটু একটু বুঝি। দাদু মায়ের চিকিৎসা করান।বহুদিন পর মা সুস্থ হলে মায়ের নামে এই বাড়িটা কেনেন, তারপর নতুন পরিবেশে মা আর ছেলের নতুন জীবন শুরু হয়। মা সুস্থই ছিলেন ।আমাদের নতুন সংসার দেখে মা খুশীই ছিলেন কিন্তু গত এক বছরের মধ‍্যে মায়ের আচরণে কিছু পরিবর্তন চোখে পরতে থাকে। যাতে করে বুঝতে পারি আমাদের স্বামী -স্ত্রীর একসাথে থাকা মা মেনে নিতে পারছেন না। হয়তো পুরোনো কিছু স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে বেরাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই মা তোমাকে নিয়ে আমার কাছে নানান অভিযোগ করতে থাকেন আমার বিশ্বাস হতোনা তবুও বিশ্বাস করছিনা সে কথাও বলতে পারতাম না। দাদু অনেক কষ্টে সুস্থ করে মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এতোদিন মা আর ছেলে আমরা সুখেই ছিলাম। মা তাঁর সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাবার অভাব আমাকে বুঝতে দেন নি তাই তাঁর মনের কথা বুঝে তোমাকে অবিশ্বাস করে দূরে ঠেলে দিতে বাধ‍্য হয়েছিলাম। মা কিন্তু চাইছিলেন তাঁর জীবনে যা ঘটেছে তাই যেন তোমার জীবনেও ঘটে….তাই ডিভোর্সের নোটিশ পাঠালাম। তুমি কোনো বাঁধা দিলে না…ভেবেছিলাম তুমি হয়তো রাজি হবে না। কিন্তু তোমার আত্মসন্মান তোমাকে রাজি হতে বাধ‍্য করলো। মা আর স্ত্রীর মাঝখানে সকলের অলক্ষে আমি সর্বহারার মতন ছটফট করেছি। তোমাকে অকারণে অপমান করে অনুতপ্ত আমি ‘অনুতাপ ‘ হয়ে মেসেঞ্জার তোমাকে ম‍্যেসেজ পাঠাতে থাকি। তুমি কোন সারা দাও নি। জানতাম…আমার বিশ্বাস ছিল তুমি চরিত্রহীনা নও। হাতেনাতে তার প্রমাণ পেলাম। তোমাকে মিথ্যা সন্দেহের অভিযোগে অভিযুক্ত করে আমিও অনুতপ্ত। তাই অনুতাপ নামে নাছোড়বান্দার মতন রোজ তোমাকে ম‍্যেসেজ করেই যাই। সেদিন কি করে জানিনা মায়ের কাছে বাবার অসুস্থতার খবর আসে…! এখন মনে হয়, মা নিশ্চয়ই বাবার খবর রাখতেন কিংবা বাবা রাখতেন আমাদের খবর। সঠিকভাবে জানা নেই। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত‍্যুর পর বাবা একলা তায় অসুস্থ। মা এই সংবাদ পেয়ে পাগোলের মতন বলতে থাকেন তাঁকে তাঁর স্বামীর কাছে যেতেই হবে স্বামী অসুস্থ তায় একলা এখন কাছে ফিরে যাওয়া তাঁর ধর্ম তাঁর কর্তব্য। মা চলে গেলেন। পরের দিনই আমাকেও ওখানে ডেকে পাঠালেন। আমি যাই নি বলেছি -“আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছে। অন‍্য কোথাও চলে যাবো। তুমি চিন্তা কোরোনা। বাবার খেয়াল রেখো।” আমি ম‍্যেসেঞ্জারে তোমাকে লিখলাম ‘ আজ আমি আমার প্রিয় আপন জনকে হারালাম ‘। জানতাম তুমি বুদ্ধিমতী। ঠিকই তুমি অনুতাপকে চিনতে পেরেছো। আমায় যিনি গর্ভেধারণ করেছেন তিনি অবশ‍্যই আমার আপনজন। এই সংবাদ তোমাকে বিচলিত করবেই আর তুমি আসবেই। জানিনা কেনো এই বিশ্বাস আমার ছিল।” ইন্দ্রানী এতোক্ষণ চুপ করে শুনছিল। বিপ্লব উঠে এলো তার কাছে, বসলো তার পায়ের কাছে হাতজোড় করে বললো,
-” মা যদি তাঁর বহুদিন আগে ডিভোর্স করা স্বামীর সকল দোষকে ক্ষমা করে তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারেন তুমি কি পারোনা এই কয়েক মাস আগে অকারণে ডিভোর্স করা স্বামীকে ক্ষমা করে ফিরে আসতে? কথা দিচ্ছি মাকে আর আমাদের সাথে জড়াবো না তিনি তাঁর স্বামীকে ফিরে পেয়েছেন। তাঁর সাথে সুখে থাকুন।” ইন্দ্রানী বললো,-“সকলেরই নিজের মতন সুখে থাকার,ভালো থাকার অধিকার আছে..তুমি কেন তাঁদের সুখে সুখী হতে পারছো না।
তোমারও এই বয়সে বাবা-মাকে একলা করে দেওয়া উচিৎ নয়।” ইন্দ্রানী উঠে দাঁড়ায়। বিপ্লব কাতর কন্ঠে বললো,-“সব মানছি.. কিন্তু তাঁরও তো উচিত পুত্র আর পুত্রবধূকে সুখী হতে দেখা।’ বিপ্লবও উঠে দাঁড়ায়। ইন্দ্রানী বললো, -“জানিনা আবার বৃষ্টি শুরু হলো কিনা ! বাবা হয়তো বাড়ি ফিরে এসেছেন। আমাকে না দেখতে পেলে শুধু শুধু রাগারাগি করবেন। আমি এবার ফিরবো।” বিপ্লব ইন্দ্রানীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, -” বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার জন‍্য মাকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন। আমি মায়ের মানসিক অসুস্থতার জন‍্য। কারণ,ওটা না করলে অশেষ অশান্তির মধ‍্যে তুমি জর্জরিত হতে আর শেষমেষ যা তখন ঘটেছিল তা এখন ঘটতো আরও বিশ্রী আর তিক্ত পরিবেশে। … আমরা আজ দ্বিতীয়বার মুখোমুখি দাঁড়ানোর অবস্থায় আসতে পেরেছি কিন্তু সম্পর্কে তিক্ততা বাড়লে এই অবস্থায় আমরা শান্তভাবে মুখোমুখি কখনোই দাঁড়াতে পারতাম না ইন্দ্রানী। প্লিজ,ভেবে দেখো একবার।” ইন্দ্রানী মৃদু হাসলো। -“দাঁড়াও বাবাকে ফোন করে জানাই আগে, আমি সেফ আছি,নাহলে,মায়ের সাথে অশান্তি শুরু করবেন।” ফোন করার পর ইন্দ্রানী বললো,-“আমাকে তোমার জীবন থেকে তুমি বাদ দিয়েছিলে তাই আমাকে কি ভাবে আবার ফেরাবে সে ভাবনাও তোমার। আপাতত তোমার মা-বাবার নতুন সংসার দেখতে তোমার সাথে আমিও যাবো। দেখি তাঁদের নতুন সংসারে আমার ঠাঁই হয় কিনা।’

Google search engine

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here